অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি—এসব নিয়ে আমরা প্রায়ই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ি। মনে হয়, বুঝি আর টিকে থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু ইতিহাস দেখায়, প্রতিটি যুগেই মানুষ একই ধরনের আশঙ্কায় ভুগেছে। আজ থেকে এক যুগ আগে, এমনকি কয়েক শতাব্দী পূর্বেও মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে অনুরূপ শঙ্কা অনুভব করত।
তবে সত্যিকারের মুমিন কখনোই ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। কেননা তারা জানেন, সমগ্র সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশ্রিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা: ১৪৩) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে।’ (সুরা আরাফ: ১৫৬)
রিজিকের মালিক আল্লাহ
আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির রিজিকের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। যারা তাঁকে ভয় করে ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তিনি তাদেরকে অকল্পনীয় উৎস থেকে রিজিক দান করেন। এটা আল্লাহর অঙ্গীকার, আর তাঁর অঙ্গীকার সত্য। ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেন।’ (সুরা তালাক: ২-৩)
আমরা কতটুকু জানি?
আমরা মনে করি, ভবিষ্যতের সবকিছুই আমাদের ধারণায় আনা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শৈশবে কি আমরা কল্পনা করতে পারতাম আমাদের যৌবন কেমন হবে? কারা আমাদের বন্ধু হবে? পড়ালেখা কীভাবে শেষ করব? কী পেশায় নিয়োজিত হব? কাকে বিয়ে করব?—কিছুই তো জানতাম না। ঠিক তেমনই, আগামীকাল কী নিয়ে আসবে, তাও আমাদের অজানা। এই অজানার ভয়ে অনেকেই ব্যাকুল হয়ে পড়েন।
কোরআনের দিকনির্দেশনা
পবিত্র কোরআন আমাদেরকে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, এসব নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রাখো এবং নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে যাও। ‘যদি আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করেন তবে তোমাদের উপর বিজয়ী কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করেন তবে কে এমন আছে যে, তোমাদেরকে এরপরে সাহায্য করবে? আর আল্লাহর ওপরই যেন মুমিনগণ ভরসা করে।’ (সুরা ইমরান: ১৬০)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা তাঁর ওপর ভরসা করে।’ (সুরা ইমরান: ১৫৯)
এই আয়াতদ্বয়ের মূল বার্তা হলো: আল্লাহই সর্বোত্তম সাহায্যকারী ও বন্ধু। তাঁর ওপর ভরসা করলে তিনি সন্তুষ্ট হন। যখন স্বয়ং আল্লাহ সাহায্যের নিশ্চয়তা দেন, তখন দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে কি?
মুমিনের অবস্থান
একজন মুমিন কখনোই ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয় না। অশুভ চিন্তা বা উৎকণ্ঠা তার সঙ্গী হয় না। বরং সব পরিস্থিতিতে আল্লাহকেই যথেষ্ট মনে করে এবং তাঁর উপরই পূর্ণ আস্থা রাখে। মুমিনের হৃদয়নিঃসৃত বাণী হলো- ‘...আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। আমি তাঁর ওপর ভরসা করেছি এবং তিনি মহান আরশের অধিপতি।’ (সুরা তাওবা: ১২৯)
আল্লাহর অঙ্গীকার ও আমাদের করণীয়
পবিত্র কোরআনের এই বাণীগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করলে হৃদয়ে শান্তি ও প্রশান্তি আসবে। বিশেষভাবে সুরা তালাকের এই আয়াতটি মনে আশা জাগায়- ‘তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করবেন যা সে কল্পনাও করতে পারেনি। আর যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার উদ্দেশ্য পূরণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটি পরিমাপ নির্ধারণ করে রেখেছেন।’ (সুরা তালাক: ৩)
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতে নিযুক্ত থাক, আমি তোমার হৃদয় ধন-সম্পদে পূর্ণ করে দেব এবং তোমার অভাব দূর করে দেব। তুমি তা না করলে আমি তোমার হাত কর্মব্যস্ততায় পূর্ণ করে দেব, তবুও তোমার অভাব দূর হবে না।’ (তিরমিজি: ২৪৬৬)
বর্তমান সংকটে যারা অস্থির, তাদের জন্য আল্লাহর আরও একটি ঘোষণা- ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বেশি দেব।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭)
ইস্তেগফারের শক্তি
ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা হলো সমৃদ্ধ জীবনের অন্যতম চাবিকাঠি। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে বাড়িয়ে দেবেন।’ (সুরা নুহ: ১০-১২)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ (আবু দাউদ: ১৫১৮)
পরম দয়ালুর আশ্রয়
আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি কতটা দয়াবান, তা বোঝাতে গিয়ে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘একজন মা তার সন্তানের প্রতি যতটা দয়ালু, আল্লাহ তার বান্দার প্রতি তার চেয়েও অধিক দয়ালু।’ (বুখারি: ৫৯৯৯)
চূড়ান্ত নির্দেশনা
অতএব, ভবিষ্যৎ নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা করা মুমিনের কাজ নয়। আমাদের কর্তব্য হলো:
১. আল্লাহর উপর দৃঢ় ভরসা (তাওয়াক্কুল) রাখা
২. সর্বোৎকৃষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া
৩. নিয়মিত ইস্তেগফার ও শুকরিয়া আদায় করা
বাকী সবকিছুর দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়ে নিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে ভবিষ্যতের ভয় থেকে মুক্ত থাকার, খোদাভীতি অর্জনের এবং সর্বদা ইস্তেগফার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
ইএফ/