বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যু হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত একটি ছবিকে ঘিরে এই গুজব ছড়ায়। ছবিটি শেখ হাসিনার অসুস্থ অবস্থার বা মৃত্যুর পরের কোনো দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই সেটি ভাইরাল হয়। দেশজুড়ে বিভ্রান্তি ও আলোচনার ঝড় শুরু হয়। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছবিটি শেখ হাসিনার নয়। বরং প্রতিবেশী দেশ ভারতের এক নারীর ছবি বিকৃত করে এই গুজব ছড়ানো হয়েছে।

রিউমার স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেকে দেখা গেছে, ছবিটির উৎস সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রযুক্তির অপব্যবহার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সম্পাদনার মাধ্যমে ছবিটি শেখ হাসিনার নামে প্রচার করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করেছে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল কিংবা অনলাইন ক্লিক ও রিচ বাড়ানোর কৌশল হিসেবেই এই ধরনের বিভ্রান্তিকর ছবি ছড়ানো হচ্ছে। তারা এই প্রবণতাকে ‘ডিজিটাল গুজব’ বা ভুল তথ্যের বিস্তার বলে চিহ্নিত করেছেন। এমন গুজব শুধু সামাজিক অস্থিরতাই নয়, রাজনৈতিক পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সরকার ইতোমধ্যে জানিয়েছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। গুজব ও ভুয়া তথ্যের বিস্তার রোধে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

কোনো ছবি বা তথ্য শেয়ার করার আগে তার উৎস ও সত্যতা যাচাই করতে, এবং নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র ছাড়া কোনো তথ্য প্রচারে অংশ না নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এর আগে একই ছবির একটি বিকৃত সংস্করণ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের খবর শুনে শেখ হাসিনা ভারতের নয়াদিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। সেই ফটোকার্ডেও শেখ হাসিনার একটি ছবি ব্যবহার করা হয়।

তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এটি শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক কোনো ছবি নয়, বরং অন্য এক নারীর ছবি সম্পাদনা করে বানানো। ৮২ বছর বয়সী ওই নারী ভারতের দিল্লি বিমানবন্দরে হুইলচেয়ার না পেয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার পরিবার আগেই হুইলচেয়ার বুক করলেও এয়ার ইন্ডিয়া তা সরবরাহে ব্যর্থ হয়। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ঘটনাটি ঘটে ২০২৫ সালের ১২ মে আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন জারির আগে।

ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ডের প্রকাশের তারিখ ছিল ১৩ মে ২০২৫। রিভার্স ইমেজ সার্চে দেখা যায়, ছবিটি ফার্স্টপোস্ট-এর ৮ মার্চ ২০২৫ তারিখের এক প্রতিবেদনের সঙ্গে মেলে, যেখানে শেখ হাসিনার পরিবর্তে ভারতের এক নারীকে দেখা যায়। পরবর্তীতে ছবিটি বিকৃত করে শেখ হাসিনার মুখ বসানো হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই ৮২ বছর বয়সী ওই নারীর নাম রাজ পাসরিচা। তিনি ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার বিধবা স্ত্রী। ৪ মার্চ বেঙ্গালুরুগামী এয়ার ইন্ডিয়ার এক ফ্লাইটে যাত্রা করেন তিনি। পরিবার আগেই হুইলচেয়ার বুক করলেও, বিমানবন্দরে সেটি সরবরাহ করা হয়নি। পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে তিনি আইসিইউতে ভর্তি হন। বিষয়টি তার নাতনি পারুল কানওয়ারের এক্স (টুইটার) পোস্টের মাধ্যমে সামনে আসে।

ঘটনাটি নিয়ে এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইকোনমিক টাইমস ও এবি পি লাইভসহ একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ২০২৫ সালের ১২ মে। অর্থাৎ, রাজ পাসরিচার ঘটনার অনেক আগে এই ছবিটি তোলা হয়েছিল।

ফলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ভারতের ওই নারীর ছবিতে শেখ হাসিনার মুখ বসিয়ে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। মূলধারার কোনো সংবাদমাধ্যমেও শেখ হাসিনার মৃত্যু সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য মেলেনি। তাই উপস্থাপিত প্রমাণের ভিত্তিতে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া ছবিটিকে ‘বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ইএফ/