সংবিধানসংশ্লিষ্ট সংস্কার আগামী সংসদে অনুমোদনের পর তা গণভোটে দেয়ার পক্ষপাতী বিএনপি। এ বিষয়ে বিচার বিভাগের মতামতও নেয়া যেতে পারে বলে দলটি তাদের অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে জানিয়েছে। জানা গেছে, নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা করে বিএনপি তাদের এই অবস্থান চূড়ান্ত করেছে। দলটি বলেছে, সংবিধানসংশ্লিষ্ট নয়, জুলাই সনদে স্থান পাওয়া এমন সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করে যেকোনো সময় কার্যকর করতে পারে, এতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। ১২ দলীয় জোট, ১১ দল, এনডিএম, এলডিপি, লেবার পার্টিসহ কয়েকটি দল ও জোট এ অবস্থানকে সমর্থন করেছে বলে জানা গেছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিতর্ক চলছে, সে ক্ষেত্রে দলের ‘কনসার্ন’ বা চিন্তার জায়গা আসলে কী, তা পরিষ্কার করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেছেন, বিএনপি এমন কোনো নজির তৈরি করতে চায় না, যেটা অনুসরণ করে ভবিষ্যতে অন্য কেউ সহজে সংবিধান সংশোধন করে ফেলতে পারে।
রাষ্ট্রসংস্কার নিয়ে কাজ করা বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, সংবিধান সংস্কারের যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো সংসদে সংশোধিত হবে। তার আগে যদি কোনো বৈধ, আইনানুগ বা সাংবিধানিক পন্থা কেউ আবিষ্কার করতে পারেন, দেশের স্থিতিশীলতা ও জাতীয় স্বার্থে তারা তার সাথে একমত হবে; কিন্তু দলটি এমন কোনো বাজে প্রিসিডেন্ট (নজির) তৈরি করতে চায় না, যেটা দুই বছর-পাঁচ বছর পরে আবার কেউ প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে।
জুলাই সনদের বাস্তবায়নের পদ্ধতি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিচার বিভাগের মতামত নেয়া যেতে পারে। তবে আগে সবার একমত হতে হবে যে, সেটি সবাই মেনে নেবে। কারণ সেটি মানতে একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে। এই অবস্থায় এসে যদি আর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, সেটি আমরা পর্দার আড়ালেও আলোচনা করতে পারব। প্রয়োজনে পর্দার অন্তরালেও আমরা আলোচনা করব জাতির স্বার্থে।
বিএনপি মনে করে, জুলাই সনদ রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল। এটা নিয়ে বিচার বিভাগের কিছু বলার ক্ষমতা না-ও থাকতে পারে। কারণ বিচার বিভাগ আইনসভাকে নির্দেশ দিতে পারে না, কেবল পরামর্শ দিতে পারে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন; কিন্তু বারবার যদি নতুন ফ্রন্ট খোলা হয়, তাহলে কতবার তা কারেকশন করা হবে। তাদের অভিমত, সাংবিধানিক বিষয়গুলো ছাড়া যে পয়েন্টগুলোতে সবাই রাজি হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে কোনো অসুবিধা নেই। সবাই এ ক্ষেত্রে একটা কমিটমেন্টে (অঙ্গীকার) আসতে পারে, যেখান থেকে যাতে কেউ না সরতে পারে। পরবর্তী সময়ে যারাই সংসদে যাবে, তারা যেন এটা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়। বিএনপির নেতারা বলেছেন, জাতীয় প্রতিশ্রুতি হিসেবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা উচিত। এর বাইরে গিয়ে কেউ যাতে রাজনীতি করতে না পারে।
জানা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্তুষ্ট রেখে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ বের করার চেষ্টা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষজ্ঞ প্যানেল সনদ বাস্তবায়নে দু’টি পরামর্শ দিয়েছে। যাতে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের অভিমত গ্রহণ থাকবে।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সাথে ঐকমত্য কমিশনের ভার্চুয়াল সভায় সম্প্রতি এসব আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধে আটকে থাকা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে দু’টি পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল।
প্রথম পরামর্শে রয়েছে- সংবিধান আদেশ, ১০৬ অনুচ্ছেদে মতামত গ্রহণ এবং গণভোটের পরামর্শ থাকবে। সংবিধান আদেশে গণভোটের বিধান রাখা হবে। আদেশ জারির পরে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের অভিমত গ্রহণে রাষ্ট্রপতির রেফারেন্স পাঠানো হবে।
দ্বিতীয় পরামর্শে রয়েছে- সংসদ নির্বাচনের সাথে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার প্রস্তাব করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ পরামর্শ অনুযায়ী, আগামী সংসদ নির্বাচনেই গঠিত হবে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভা। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে। অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে গণপরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঁচ বছর মেয়াদি সংসদে রূপান্তরিত হবে।