গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার ‘কোনো সুযোগ নেই’, প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরার কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়টি ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তাদের উদ্বেগে কথা তুলে ধরেছেন তারা।
নাহিদ বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টাই পুরা জুলাই সনদের আওতাভুক্ত আছে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণভোটের আগেই হয়, সেটাকে বাস্তবায়ন করতে চান, তাহলে নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠন করতে হবে জুলাই সনদের আইন অনুযায়ী বা সেখানকার ঐকমত্য অনুযায়ী।
“ফলে এই বিষয়গুলো আসলে যারা বলছেন, তারা কোন বিবেচনায় বলছেন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বলছেন, এটা আসলে সন্দেহজনক।”
১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর তা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার এ উদ্যোগ নিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে থাকলেও এনসিপি সনদে সই করেনি মতভিন্নতার কারণেই।
মঙ্গলবার সন্ধায় বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারেরর প্রধান। আর বুধবার এনসিপির সঙ্গে বৈঠক শেষে সন্ধ্যা ৬টায় জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
বৈঠকে শেষে যমুনা থেকে বেরিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদল’ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, “আমরা আজকে প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে এসেছিলাম কতগুলো রাজনৈতিক কনসার্ন নিয়ে কথা বলার জন্য। বিশেষ করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেই জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠানকে অর্থবহ, নিরপেক্ষ, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এই মুহূর্ত থেকে যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখন কেয়ারটেকার গভার্নমেন্টের আদলে নিতে হবে।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট বলতে আমরা যা বোঝাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ভূমিকা, সেই ভূমিকায় তাদেরকে যেতে হবে। সেজন্য প্রথমেই যে বিষয়টির প্রয়োজন হবে, তা হচ্ছে, প্রশাসনকে জনগণের কাছে পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষ করে তৈরি করতে হবে।”
বুধবার বিকাল ৫টার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের বৈঠক শুরু হয়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন সারজিস আলম, সামান্থা শারমিন ও খালিদ সাইফুল্লাহ।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এনসিপি নেতারা। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়
বৈঠকে শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, “তত্ত্বাবধয়ক সরকার এর বিষয়টা কিন্তু জুলাই সনদের আওতাধীন। সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে গঠিত হবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে, সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বিষয়টা আছে। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুলাই সনদে আসবে। গণভোটের পরে এ বিষয়ে আসলে চূড়ান্ত হওয়া সম্ভব।
“এর আগে তত্ত্বাবধক সরকার যাওয়ার কোন ধরনের সুযোগ নেই। ফলে এই কথা বলেন যারা, তাদের কোনো ধরনের দুরভিসন্ধি রয়েছে “
এনসিপি মনে করেন, সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব।
“সেই অঙ্গীকার নিয়েই তারা কিন্তু সরকার গঠন করেছে।”
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কমিশন পুনর্গঠন চেয়ে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “আমাদের নিবন্ধন পাওয়া থেকে শুরু করে এবং জাতীয় লীগ নামে যে আরেকটা দলকে নিবন্ধন দেওয়া হল। শাপলা প্রতীক নিয়ে আমাদের সাথে কী রকম আচরণ করা হচ্ছে এবং ইশরাক হোসেনের মামলায় নির্বাচন কমিশনের যে অবস্থান ছিল।
“পুরু প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের যেই কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যে সেই বিষয়টা আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেছি।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছি। নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান আচরণ আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে এটা নিরপেক্ষ হচ্ছে না। এটা স্বচ্ছ হচ্ছে এবং নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেভাবে কার্যক্রম করার কথা ছিল সেটা করছে না।
“কিছু কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে এবং কোনো কিছু, কোনো দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ তারা করছে। বিগত সময়গুলোতে নির্বাচন কমিশন যেই যেই পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সেখানে কীভাবে তাদের পক্ষপাতিত্ব ফুটে উঠেছে। সেই বিষয়ে আমরা বলেছি।
“একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। সুষ্ঠু নির্বাচন যদি না হয়, এর দায় সরকারের উপরে আসবে। ফলে আমরা সরকারকে সে বিষয়টি অবহিত করেছি। এবং আমরা মনে করি যে নির্বাচন কমিশন এই মুহূর্তে পুনর্গঠন হওয়া প্রয়োজন।”
শাপলা প্রতীক না দেওয়া হলে আপনারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কি না?
জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্য কোনো প্রতীক তারা নেবেন না। নির্বাচন কমিশন কেন তাদের শাপলা প্রতীক দেবে না, তার আইনি, সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দিলে তখন তারা অন্য প্রতীকের বিষয়ে বিবেচনা করবেন।
“তার আগে পর্যন্ত সেটা যদি নির্বাচন কমিশন না দেয়, তার মানে সেটা শুধু প্রতীকের ইস্যু না, এটা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। নির্বাচন কমিশন ন্যায়বিচার করছে কিনা একটা দলের সাথে, সেটার প্রশ্ন। ফলে যে নির্বাচন কমিশন আমাদের নিবন্ধন এবং প্রতীক বিষয়ে আমাদের সাথে ন্যায়বিচার করে না। তাদের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে আমরা নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়বিচার পাব, সঠিক ফলাফল পাব, সেটাও তো আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না।”
ভাগ বাটোয়ারায় জড়িত উপদেষ্টাদের তালিকা প্রধান উপদেষ্টার হাতে দেওয়ার কথা জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, “জনপ্রশাসন এবং উপদেষ্টা পরিষদ বিষয়ে কিছু বক্তব্য দিয়েছি। জনপ্রশাসন প্রশাসনে যেভাবে বদলি পদায়নগুলো হচ্ছে, সেটা আসলে কীসের ভিত্তিতে হচ্ছে? সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষ এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন হচ্ছে কিনা?
“আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি যে প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগ বাটোয়ারা হচ্ছে, বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যারা পরিচিত তাদের মধ্যে, নিজেদের মধ্যে প্রশাসন, এসপি/ডিসি এগুলো ভাগ বাটোয়ারা করছে এবং নির্বাচনের জন্য তারা সেই তালিকা করছে।
“আমরা প্রধান উপদেষ্টা কাছে সেই নামগুলো আমরা বলেছি যে কারা কারা কোন কোন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন বা প্রশাসনে ভাগ বাটোয়ারার সাথে জড়িত আছেন। সার্বিকভাবে এটা বিবেচনা করতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি যে অবশ্যই এই উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষ এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা লাগবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। সেই দাবির সাথে আমাদের ভিন্নমত নেই, কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ পুরা পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধক সরকার নিয়ে আসা এইটার আসলে সুযোগও নেই, আইনগতভাবে।
এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “উপদেষ্টা পরিষদের ভিতর থেকেও সেই দলগুলার সাথে সে ব্যাপারে সহায়তা করছে। এভাবে চললে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকার যাতে নিরপেক্ষভাবে ফাংশন করে এবং উপদেষ্টা পরিষদে যাদের বিরুদ্ধে এই সংশ্লিষ্টতাগুলো রয়েছে অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দলীয় পক্ষপাতের তাদের বিষয়ে, যাতে প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত নেন সেটা বলেছি, তাদের তালিকা দিয়েছি।”
উপদেষ্টাদের নিয়ে নাহিদ বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলা আছে, সে অভিযোগগুলা যাতে তারা বিবেচনা করে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে নেন। উপদেষ্টা পরিষদের দক্ষতা যাতে বৃদ্ধি করা হয়, সে বিষয়ে আমরা বলেছি।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চয়তা পাওয়ার পরে তারা স্বাক্ষর করবেন তুলে ধরে এনসিপি প্রধান বলেন, “জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি সেখানে অংশগ্রহণ করে নাই। ফলে আমরা আমাদের অবস্থান সরকারের কাছেও তুলে ধরেছি। জুলাই সনদে শুধু কাগজের মূল্যে আমরা বিশ্বাসী নই, ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নটা কীভাবে হবে সেইটার সম্পর্কে নিশ্চয়তা পাওয়ার পরে আমরা স্বাক্ষর করব।
“সেক্ষেত্রে জুলাই সনদ আমরা একটি সাংবিধানিক আদেশের কথা বলছি, যে আদেশটা ড. মুহাম্মদ ইউনুস প্রধান হিসেবে জারি করবেন। গণঅভ্যুত্থানে জনগণের যে সার্বভৌম ক্ষমতা সেটার একমাত্র বৈধতা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের আছে, সেটা প্রেসিডেন্টের নাই।”
নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ বিশেষ সংশোধন বিধিমালা ২০২৫ অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে সার্জিস আলম বলেন, “এনসিপির পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছি। যেন সেটা খুব দ্রুত করা হয়। তিনি কথা দিয়েছেন যে এটা তার টেবিলে আসার সাথে সাথে হবে। প্রত্যাশা করছি, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এটি অনুমোদন পেয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “ছাত্র উপদেষ্টাকে যদি কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখা হয়, অন্য অনেক উপদেষ্টাদেরও বিভিন্ন দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, রাজনৈতিক সাবেক ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। ফলে সেই বিষয়গুলোও সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। কারণ সরকার যখন গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন দলের রেফারেন্সে কিন্তু এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে।”
এওয়াই/আবির