দৈনন্দিন রান্নার কাজে বহুল ব্যবহৃত পেঁয়াজের দামে হঠাৎ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজিতে দাম বেড়েছে ৩০-৪০ টাকা। বাজারে দামের এই হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি ও সরবরাহ সংকটে সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ চেইন ঠিক না থাকায় মজুত সংকটে পড়েছে পেঁয়াজের বাজার। অন্যান্য বছর যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হতো তা চলতি বছর হয়নি। তারা বলছেন, বিদেশি আমদানিতে বাধা পড়ায় পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।
খুচরা ব্যবসায়ী মিজান ঢাকা মেইলকে জানান, দাম ঠিক কি কারণে বেড়েছে জানি না। আমরা বেশি দাম দিয়ে এনেছি। তাই একটু বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম বাড়ার পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজার থেকে যে দামে কিনি, সেই অনুযায়ী বিক্রি করি। আমরা নিজেরাও জানি না কেন এমন বাড়ল। তবে দাম বাড়ায় বেচাকেনা কমেছে।
যাত্রাবাড়ী আড়তের ব্যবসায়ী রহিম মাঝি বলেন, দেশে বছরে প্রায় ৩৬ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এবার পেঁয়াজ উৎপাদনও হয়েছিল প্রায় ৩৬ লাখ টন। আমদানি করা পেঁয়াজের কোনো দরকার ছিল না। তবে টানা বৃষ্টিতে কৃষকের প্রায় দুই লাখ টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। এই কারণেই পেঁয়াজের বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি মন্ত্রণালয় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা অযাচিত পরিসংখ্যানে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভোক্তার চাহিদা ও যোগানে হিসেবে আজ এই সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর ৫-৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। কিন্তু যে কোনো কারণে তা এবার হয়নি। এছাড়া দেশে উৎপাদন বাড়লেও পরবর্তী সংরক্ষণ বা আমদানি-আবশ্যকতা ঠিকমতো পূরণ হয়নি। যেমন প্রায় ২৫ শতাংশ পেঁয়াজ স্টোরেজ ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন।
ভোক্তারা বলছেন, আবারও বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে মুনাফা লুটার পাঁয়তারা করছে। সরকার বাজার মনিটরিংয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে সবজির দাম কিছুটা কমলেও পেঁয়াজের এমন দাম বৃদ্ধিতে হাঁসফাঁস করছে সাধরণ মানুষ। কারণ প্রতিবেলা রান্নায় অতিপ্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ এই পেঁয়াজ। পেঁয়াজ ছাড়া মাছ-মাংস কিংবা সবজি রান্নার স্বাদ ফিকে হয়ে যায়।
যাত্রাবাড়ী, শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত শুক্রবার যেখানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৯০ টাকায়, সেখানে আজ আরেক শুক্রবার (৭ নভেম্বর) বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
পেঁয়াজের দাম বাড়ার তথ্য মিলেছে, সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সবশেষ পরিসংখ্যানেও। তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে যা বেড়েছে ৪৪.৮৩ শতাংশ।
পেঁয়াজের আড়তদাররা জানান, গত কয়েক মাসে বাইরের দেশ থেকে কোনো পেঁয়াজ আমদানি করা হয়নি। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই দেশের চাহিদা মেটানো হয়েছে। তবে এখন দেশি পেঁয়াজেরও কিছুটা সংকট চলছে। আবার অনেক অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে মজুত করছে তাই দাম বাড়ছে। দাম হঠাৎ করে বাড়ায় কমে গেছে বেচাকেনাও।
বাজারে সম্প্রতি সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। কারণ এখন শীতের মওসুম শুরু। তাই দাম কম। কিন্তু হঠাৎ পেঁয়াজের দামে আগুন। শুধু পেঁয়াজ নয় মুদিপণ্যসহ প্রায় বহু পণ্যের দামই বাড়তি। সরকার এসব কিছুতে নজর দেয় না। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। মহিউদ্দিন আহমেদ, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সামাজ
আমদানিকারকরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানির বিকল্প নেই। আগস্ট মাসে পেঁয়াজের দাম কিছুটা বড়লে সরকার আমদানির অনুমতি দেয়। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে দুই দিনের মাথায় তা বন্ধ করে দেয়। ফলে খুব সামান্যই এবছর আমদানি হয়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত আইপি (Import Permit) দেয়া। আমদানি হলে পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকায় নেমে আসবে।
হিলি স্থল বন্দরের ব্যবসায়ী শহীদুল বলেন, পেঁয়াজ আমদানিতে এ বছর বাধা দেওয়া হয়েছিল। ফলে সংকট হওয়াটা স্বাভাবিক। দাম আরও বাড়তে পারে। আর এখন আমদানির ফের অনুমতি দিলে আগের সেই দামে পাওয়া যাবে না। ফলে ভোক্তাকে বেশি দামেই কিনতে হবে।
পেঁয়াজের দামের হঠাৎ এই ঊর্ধ্বমুখিতায় বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। তাদের দাবি, বাজারে নতুন করে সিন্ডিকেট শুরু হয়েছে। পাইকারি, মোকাম ও আড়তে এখন থেকেই নজরদারি বাড়াতে হবে, তা না হলে সামনে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে যাবে।
পেঁয়াজের দাম বাড়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সামাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, বাজারে সম্প্রতি সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। কারণ এখন শীতের মওসুম শুরু। তাই দাম কম। কিন্তু হঠাৎ পেঁয়াজের দামে আগুন। শুধু পেঁয়াজ নয় মুদিপণ্যসহ প্রায় বহু পণ্যের দামই বাড়তি। সরকার এসব কিছুতে নজর দেয় না। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই।
প্রতিবছর ভারত থেকে ৫-৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হতো। এ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হয়েছে। আমদানি লাগবে না। সামান্য আমদানি হয়েছে। ফলে আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে পেঁয়াজের বাস্তবিকই সংকট আছে। জানুয়ারিতে আসবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ। তার আগ পর্যন্ত সংকট থাকতে পারে। তবে রোববারের দিকে এলসি খোলার অনুমতি দিতে পারে। এখন আবার ভারত সুযোগ বুঝে হয়তো চড়া দামে বিক্রি করবে। এতে খুচরা বাজারে ১৫০-২০০ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম উঠতে পারে।
এদিকে পেঁয়াজ আমদানির এলসি বন্ধ থাকায় দাম বেড়েছে কিনা জানতে চাইলে ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এসএম নাজের আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, দাম বাড়ার ক্ষেত্রে এলসি বন্ধের কোনো প্রভাব নেই। এলসির আইপি তো বন্ধ হয়েছে সেই আগস্টে। আর এখন নভেম্বর মাস। এতো দিন পর তো সেই প্রভাব পড়ার কথা না। প্রভাব পড়লে আগস্ট বা সেপ্টেম্বরেই পড়তো। মূলত এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের সিন্ডিকেটের ফলেই হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মাস খানেক পর নতুন পেঁয়াজ আসবে তার আগ পর্যন্ত তারা দাম বাড়িয়ে বড় অঙ্কের মুনাফা করতে চায়।
তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। সরকার এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা জনগণের পকেট কাটতে নেমেছে।
তবে কনজুমান অ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন ভিন্ন কথা। তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভুল সিদ্ধান্তকে এই সংকটের জন্য দায়ী করছেন। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, প্রতিবছর ভারত থেকে ৫-৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হতো। এ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হয়েছে। আমদানি লাগবে না। সামান্য আমদানি হয়েছে। ফলে আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে পেঁয়াজের বাস্তবিকই সংকট আছে। জানুয়ারিতে আসবে মুড়িকাটা পেঁয়াজ। তার আগ পর্যন্ত সংকট থাকতে পারে। তবে রোববারের দিকে এলসি খোলার অনুমতি দিতে পারে। এখন আবার ভারত সুযোগ বুঝে হয়তো চড়া দামে বিক্রি করবে। এতে খুচরা বাজারে ১৫০-২০০ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম উঠতে পারে।
ইএফ/