বহু বিতর্ক ও সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেম আলির ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাশেম আরমান আট বছর ধরে যে ‘আয়নাঘর’-এ গুম ছিলেন তার আগে থেকেই তিনি চলে যেতে সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন বলে তাঁর নিজ লেখা বই ‘আয়নাঘরের সাক্ষী: গুম জীবনের আট বছর’-এ উঠে এসেছে। বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এবং এতে গুম হওয়া, গুম হওয়ার আগে পাওয়া সতর্কবার্তা ও পরে যে বিভীষিকাময় জীবন কাটাতে হয়েছিল সবকিছু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন আরমান।

বইতে আরমান লিখেছেন, গুম হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে তিনটি আলাদা সূত্র থেকে তাকে জানানো হয় যে তাকে ‘উঠে নিয়ে যাওয়া’ বা গুম করার পরিকল্পনা আছে। প্রথম সতর্কবাণীটি এসেছিল শেখ পরিবারের এক সদস্যের মুখ থেকে যিনি আরমানের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে বার অ্যাট ল-এ পড়ার সময় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। সেই পরিচিতি আরমানকে শান্ত জায়গায় ডেকে বলে দেন, “তোমাকে দ্রুত দেশ ছাড়তে হবে” আর এর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যান।

দ্বিতীয়বার সতর্ক করেন বিএনপির এক শীর্ষ নেতার ছেলে। তিনি আরমানকে পুনরায় ডেকে একটি নিরাপদ স্থানে আটকে জানালে, “তোমাকে নিয়ে সরকার খুব খারাপ ধরনের পরিকল্পনা করছে; দ্রুত দেশের বাইরে চলে যাও।”

এছাড়া একটি তৃতীয় সূত্র সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও একইরকম সতর্কতা দেন। আরমান জানায়, ওই জেনারেলকে এক সংবাদিকের কাছে শোনা তথ্য অনুযায়ী এনএসআই প্রধান বলেছিলেন যে “মীর কাসেমের ছেলে খুব বাড়াবাড়ি করছে” এবং আন্তর্জাতিকভাবে যে সমালোচনার সূত্রপাত হয়েছে তার পেছনে তিনি দায়ী সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেই জেনারেল তাকে দ্রুত দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

তবে আরমান তাঁর বইয়ে লেখেন যে, শেষ সিদ্ধান্তে তিনি বাবা মীর কাশেম আলির অনুরোধ ও নির্দেশনা মেনে দেশে থাকাই বেছে নেন। ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট তিনি বাবার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করেন; তিন দিন পর, ৯ আগস্ট ২০১৬ তার দিনটি তাঁকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ আট বছর ‘আয়নাঘর’-এ রাখা হয় তাকে দীর্ঘ সময় ধরে শ্বাসরুদ্ধকর ও নির্মম জীবন কাটাতে হয়।

বইতে আরমান বর্ণনা করেছেন যে, সতর্কবার্তাগুলো পাওয়ার পর তিনি আত্মবিশ্লেষণ করেন। বিচার-বিবেচনার পরে বাবার পাশে থাকার দায়িত্ববোধই তাঁকে দেশে থাকতে প্ররোচিত করে। তিনি নানা বাধা-নিষেধ পেরিয়ে আইনজীবী পরিচয়ে বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ নেন ৬ আগস্টের সাক্ষাতের দিন বাবাকে সতর্কবার্তার কথা জানান এবং বাবার সাহসী চোখে দেখে হিম্মত ফিরে পান। বাবার কথাগুলো ছিল, “আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো, বেটা; তুমি দেশেই থেকো পরিবারের জন্য তোমার থাকা দরকার।” এই কথাই শেষ পর্যন্ত আরমানকে দেশের মাটিতেই থাকার সিদ্ধান্তে দৃঢ় করে তোলে।

আরমানের লেখায় উঠে এসেছে, গুমের বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত নয় এটি দেশের বিচারব্যবস্থা, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত জটিল একটি ঘটনাচক্র। তিনি উল্লেখ করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে ‘আন্তর্জাতিক সমালোচনা’ দেখা দিয়েছে তার পেছনে যাদের দায় আছে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের খোঁজে নেমে ছিল এবং তদন্তের এক পর্যায়ে তাঁকেই সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু করা হয়।

বইটিতে আরমান বিস্তারিতভাবে আঞ্চলিক ও জাতীয় ঘটনাপ্রবাহ, গুম হওয়ার সময়ের চিত্র, কষ্টের দিনগুলোর বর্ণনা এবং মুক্তি পাওয়ার পরকের ঘটনাবলি উপস্থাপন করেছেন। তিনি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান এরই প্রেক্ষিতে এই স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে বলে পাঠক-বিচারকের অনেকে মন্তব্য করেছেন।

পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও প্রেক্ষাপট: বই প্রকাশের পর থেকে রাজনৈতিক মহল, মানবাধিকার কর্মী ও আইনমহল বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। অনেকে এই ইংগিতগুলোকে দেশের বিচারব্যবস্থা ও বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার ওপর প্রশ্ন তোলার সুযোগ বলে দেখছেন; অন্যদিকে কারওা বইটি ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা হিসেবে মেনে নেন।