এক সময় পুকুরের শহর নামে পরিচিত ছিল রাজশাহী। পদ্মার পাড় ঘেঁষা এই নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে ছড়িয়ে ছিল শত শত পুকুর, খাল-বিল, দিঘি ও জলাশয়। এসব শুধু প্রকৃতি নয়, নগরবাসীর জীবনের আবেগ, স্মৃতি, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান এবং পানি নিষ্কাশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। আজ সেসব কেবল কাগজে রয়ে গেছে, বাস্তবে কংক্রিটের নিচে চিরতরে চাপা পড়েছে সেই সব জলাধার।

ঘোষপাড়া ফকিরপাড়ার জোড়া পুকুর একসময় ছিল এলাকার প্রাণ। ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও এটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত পুকুরের তালিকায় ছিল। বর্তমানে সেখানে ভরাটের প্রস্তুতি চলছে। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আরডিএ মার্কেট এলাকার ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় সেখানে এক সময় ছিল ২.১৩ একর আয়তনের ‘বড়কুঠি’ পুকুর। আজ তা নেই। মিশন হাসপাতালের সামনের আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে পুকুর ভরাট করে। রাজশাহীর অন্যতম বৃহৎ জলাশয় ছিল ভদ্রা লেক। বর্তমানে সেখানে ভদ্রা পার্ক গড়ে উঠলেও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে তার অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলীন। নিউ ডিগ্রি কলেজের পাশে একটি পুকুর ছিল যা বুড়ির পুকুর নামে পরিচিত। ব্যক্তি মালিকানায় থাকলে ও ক্ষমতার দাপটে অসাধু ব্যক্তি উচ্চ মূল্যে পুকুরটি কিনে ভরাট করেছে। এছাড়াও নগরের লক্ষ্মীপুর, সপুরা, টিকাপাড়া, হাতেমখাঁ, শিরোইল, কাজলা, কেশবপুরসহ প্রতিটি ওয়ার্ডে যেসব পুকুর ছিল, আজ তা অধিকাংশই স্মৃতি।

২০১৪ সালে হাইকোর্ট নগরের ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণের নির্দেশ দেয় ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ এর রিটের পর। এর মধ্যে ৪৮টি ছিল সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। বর্তমানে মাত্র ১৯টিতে পানি আছে। অনুমতি নিয়ে ভরাট হয়েছে ৯টি, অবৈধভাবে ৮টি এবং বাকি অনেকগুলোতেই ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ভবন ও বাণিজ্যিক স্থাপনা।

সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ, অসহায়। ঘোষপাড়ার প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল জলিল বলেন, আমার ছোটবেলা কেটেছে পুকুরপাড়ে। এখন যেখানে মাছ ধরতাম, সেখানে উঠেছে দালান। কিছু পুকুর এখনো আছে, কিন্তু সেগুলো ভরাটের ষড়যন্ত্র চলছে।

লক্ষ্মীপুর এলাকার গৃহিণী সালমা খাতুন বলেন, পুকুরটা ছিল আমাদের আশীর্বাদ। এখন সেখানে মার্কেট। বৃষ্টি হলে হাঁটুপানি। শিশু-বুড়ো কেউ বের হতে পারে না। কষ্টের মধ্যে জলাবদ্ধতায় থাকতে হয়।

শিরোইল কলোনির ছোট ব্যবসায়ী নাসিমা বেগম বলেন, পুকুর ভরাট করে মার্কেট বানানো হলে আমরাও খুশি হতাম যদি উপকার পেতাম। কিন্তু বাস্তবে এতে শুধু সুবিধা নেয় বড়লোকেরা। আমাদের জীবন হলো কাদাপানির ভেতর ছুটে বেড়ানো।

সপুরা এলাকার রিকশাচালক মো. শাহীন বলেন, আগে গরমে কাজ শেষে পুকুরে ডুব দিতাম, ঠান্ডা লাগতো। এখন শুধু গরম আর গরম। কোথাও একটু জল নেই, ছায়া নেই। রাস্তায় বৃষ্টি হলে পানি, আর গরমে জ্বালা দুই দিকেই কষ্ট।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন ২০১৯ সালে ২২টি ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর অধিগ্রহণের পরিকল্পনা নেয়। ৭৯৫ কোটি টাকার প্রকল্পে সেগুলোকে পার্ক ও উন্মুক্ত জলাধার হিসেবে গড়ে তোলার কথা ছিল। কিন্তু পাঁচ বছরেও সে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।

রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো কবির হোসেন বলেন, পুকুর ভরাট করা নিঃসন্দেহে পরিবেশের জন্য একটি ক্ষতিকর দিক। রাজশাহীতে কিছু কিছু পুকুর উন্নয়ন কাজের জন্য ভরাট করা হয়েছে আবার কিছু ক্ষমতার দাপটে জোর করে দখল করা হয়েছে। আমরা সরকারি ভাবে মামলা করে যে পুকুর গুলো জোর করে দখল করা হয়েছিল সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছি।

বরেন্দ্র মিউজিয়ামের পরিচালক প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পুকুর ভরাটের কারণে রাজশাহীতে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পুকুর ছিল প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের পথ, এখন সেখানে শুধু ইট আর জঞ্জাল। গাছ কেটে, পুকুর ভরাট করে এই শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

নদী গবেষক ও পরিবেশবীদ মাহবুব সিদ্দিকী ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রথম শহুরে পুকুর রক্ষার রিট করেন হাইকোর্টে। ২০২০ সালে তার সঙ্গে যুক্ত হন এডভোকেট মঞ্জুর মোর্শেদ। মাহবুব সিদ্দিকীর করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বিভাগীয় শহরে সকল পুকুর ভরাটের বিপক্ষে রায় দেয় কিন্তু বাস্তবে বাস্তবায়নের অভাবে পুকুর হারানোর মিছিল থেমে নেই। বরং আশঙ্কাজনক ভাবে প্রতিনিয়ত বাড়ছে এই পুকুর হারানোর মিছিল।

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ১৯৫০-এর দশকে রাজশাহীতে চার হাজারের বেশি পুকুর-দিঘি ছিল। শহরের প্রতিটি বাড়ির পাশে ছিল জলাধার। বর্তমানে ১২ কাঠার বেশি আয়তনের পুকুরের সংখ্যা ২৫০টিরও কম। সত্তরের দশক থেকে শুরু হওয়া এই ভরাট প্রক্রিয়া এখন ‘দখল সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও জানান, সরকারি, আধা-সরকারি, ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক সব ক্ষেত্রেই এই ভরাটের পেছনে ভূমিকা আছে। দামি জমির মোহ, পরিকল্পনার অভাব আর রাজনৈতিক প্রভাব সব মিলিয়ে রাজশাহীর জলাভূমি আজ হুমকির মুখে।

ইএফ/