গাজায় স্বাস্থ্য খাত এক ‘বিপর্যয়ের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা ‘আগামী কয়েক প্রজন্ম ধরে চলবে’। এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস।
বিবিসি রেডিও ৪–এর টুডে প্রোগ্রামে তিনি বলেন, গাজার জনগণের নানান চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ত্রাণ সহায়তা বিপুল পরিমাণ বাড়াতে হবে।
গত ১০ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ইসরায়েল সেখানে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ত্রাণ প্রবেশে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। তবে তা গাজার ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন গেব্রিয়াসুস।
তার এই সতর্কবার্তা এমন সময়ে এসেছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র শান্তিচুক্তি পাকাপোক্ত করতে কাজ করছে। এ চুক্তিকে হোয়াইট হাউজ ২০ ধাপের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হিসাবে উল্লেখ করেছে।
পরিকল্পনায় গাজায় সাহায্য বাড়ানো এবং উভয় পক্ষের 'হস্তক্ষেপ' ছাড়াই তা বিতরণের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক গেব্রিয়াসুস বিবিসি-কে বলেন, তিনি এই শান্তিচুক্তিকে স্বাগত জানান। তবে চুক্তি কার্যকরের পর সাহায্য প্রত্যাশার তুলনায় কম বেড়েছে।
গাজার মাঠ পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সেখানকার মানুষ দুর্ভিক্ষ দেখেছে, 'ভয়াবহ' আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে রোগের বিস্তার ঘটছে।”
“তার ওপর গাজায় মানবিক সাহায্যের প্রবেশ সীমিত। সব মিলিয়ে সেখানে এক বিপজ্জনক প্রাণঘাতী পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা বিপর্যয়কর এবং ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
গাজার দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে গেব্রিয়াসুস বলেন, “যদি আমরা ক্ষুধা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে একসঙ্গে মিলাই, যা দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে, তাহলে বলা যায়, এই পরিস্থিতি আগামী কয়েক প্রজন্মের জন্য একটি সংকট।”
ত্রাণসাহায্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার:
ডব্লিউএইচও প্রধান বলেন, ত্রাণ সাহায্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি ইসরায়েলকে আহ্বান জানিয়েছেন সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও শর্ত আরোপ না করতে।
তিনি বলেন, “সব জীবিত জিম্মি ফেরত এসেছে, মৃতদের অনেকের মরদেহও হস্তান্তর করা হয়েছে—এরপরও ত্রাণসাহায্যে শর্ত আরোপের যৌক্তিকতা নেই।”
ইসরায়েল জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় দুই সেনা নিহত হওয়ার পর রোববার গাজায় ত্রাণসাহায্য প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পরদিন তা পুনরায় চালু হয়।
বর্তমানে ইসরায়েল কেবল দুটি প্রবেশপথ—কেরেম শালোম ও কিসুফিম—খোলা রেখেছে। তবে গেব্রিয়াসুস বলেন, “প্রয়োজনীয় সাহায্য পৌঁছাতে সব সীমান্তপথ খুলে দিতে হবে।”
তার ভাষায়, প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ ট্রাক গাজায় ঢুকছে, যেখানে “বাস্তব প্রয়োজন অন্তত ৬০০ ট্রাকের।”
চিকিৎসা সরঞ্জাম আটকে দেওয়া হচ্ছে:
জানান, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় অনেক সরঞ্জাম ইসরায়েল সীমান্তে আটকে দিয়েছে। এগুলো সামরিক উদ্দেশ্যে ব্রবহার হতে পারে বলে যুক্তি দিচ্ছে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ।
“একটি অস্থায়ী হাসপাতাল বানাতে তাঁবু, খুঁটি—সবকিছু লাগে। কিন্তু বলা হচ্ছে, এগুলো ‘দ্বৈত ব্যবহারের’ উপকরণ হতে পারে, তাই আটকে রাখা হচ্ছে। খুঁটি ছাড়া তাঁবু কীভাবে দাঁড়াবে?”
তিনি বলেন, হাজার হাজার ফিলিস্তিনি চিকিৎসার জন্য সাপ্তাহিক ফ্লাইটের অপেক্ষায় রয়েছেন, কিন্তু গত দুই সপ্তাহে কোনও ফ্লাইট চলাচল করেনি। “এরই মধ্যে ৭০০ জন মারা গেছেন অপেক্ষায় থাকতে থাকতে,” জানান গেব্রিয়াসুস।
যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে:
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে ডব্লিউএইচও প্রধান বলেন, “যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে মধ্যস্থতা করেছে, তাই চুক্তি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব।”
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গাজায় আরও বেশি সহায়তা প্রবেশের কথা ছিল। কিন্তু ডব্লিউএইচও ও জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা বলছে, বাস্তবে সেই সহায়তা প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, ১০ অক্টোবর থেকে ৬ হাজার ৭০০ টনের বেশি খাদ্য গাজায় প্রবেশ করেছে, তবে দৈনিক ২ হাজার টন সরবরাহের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
৭ হাজার কোটি ডলার লাগবে গাজা পুনর্গঠনে:
জাতিসংঘের হিসাবে, গাজা পুনর্গঠনে খরচ হবে প্রায় ৭ হাজার কোটি ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এর অন্তত ১০ শতাংশ প্রয়োজন গাজার স্বাস্থ্য খাত পুনর্গঠনে।
ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট কিনুন
“আমরা বহুবার বলেছি, শান্তিই সবচেয়ে বড় ওষুধ,” বলেন গেব্রিয়াসুস। “তবে যুদ্ধবিরতি এখনও ভঙ্গুর। চুক্তির পরও কয়েকবার ভেঙে গিয়ে মানুষ মারা গেছে।”
তিনি বলেন, “দুঃখজনক হল—যারা যুদ্ধবিরতির খবর শুনে রাস্তায় নেমে আনন্দ করেছিল, তাদের অনেকেই এখন মৃত। ভাবুন, যুদ্ধ শেষ বলার পরও তারা বেঁচে থাকতে পারেনি।”
এওয়াই/আবির