রাজশাহীর মহানগরীতে বাড়ছে কিশোরী মায়ের সংখ্যা। চিকিৎসক, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও স্থানীয় প্রশাসন সবাই বলছেন এই প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য ও ভয়াবহ। আইন থাকলেও দুর্বল প্রয়োগ, অসাধু কাজীদের দৌরাত্ম্য এবং সামাজিক চাপের কারণে ১৮ বছরের আগেই মেয়েরা মা হয়ে যাচ্ছেন। এতে শুধু মাতৃস্বাস্থ্য নয়, নবজাতকের নিরাপত্তাও গুরুতর ঝুঁকিতে পড়ছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের একটি ওয়ার্ডেই অন্তত ১০ জন কিশোরী মা হয়েছেন। তারা অনেকেই ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এদের মধ্যে মাইশা, সুমা আক্তার, আশিয়া খাতুন, ফেন্সি খাতুন, মমতাজ ও নাবিলা আক্তারের নাম উঠে এসেছে । জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে এই সন্তানরা বড় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে।

আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের আগে মায়ের সন্তান নিবন্ধন সম্ভব নয়। ফলে সরকারের জনসংখ্যা তথ্যও বিকৃত হচ্ছে। একজন কিশোরী মা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগস্ট মাসে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিই। কয়েক দিনের মধ্যেই সন্তান মারা যায়। আমার বয়স তখনো ১৮ পূর্ণ হয়নি।

চিকিৎসকরা বrলছেন, এ ধরনের মৃত্যুর মূল কারণ হলো মায়ের শারীরিক অপ্রস্তুতি ও অপুষ্টি। বয়স কম থাকায় গর্ভধারণের চাপ সামলাতে পারে না শরীর। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বাল্যবিবাহ টিকিয়ে রাখছে এক শ্রেণির অসাধু কাজী। তারা টাকা নিয়ে ঘরে বসেই বিয়ে পড়িয়ে দেন। মেয়েটি ১৮ হলে কাবিননামা তৈরি করে দেন। এভাবে বিয়ে গোপন রাখায় আইনের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে অসংখ্য ঘটনা। আর এতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিশোরীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের এক কাজির সঙ্গে বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি প্রথমে জানান, সব ব্যবস্থায় করা যাবে। তবে সাংবাদিক পরিচয় জানানো হলে তিনি সরে দাঁড়িয়ে বলেন,আমরা এলাকায় বিয়ে দিই, পরে কোর্টে পাঠিয়ে দিই। কাজীর এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, বাল্যবিবাহ শুধু পরিবারের ইচ্ছাতেই নয়, বিবাহ নিবন্ধকের সহযোগিতায়ও হচ্ছে। অথচ আইন অনুযায়ী কাজীই সবচেয়ে বেশি দায়ী।

শিক্ষা ও স্বাধীনতার স্বপ্ন অকালেই ভেঙে যাচ্ছে কিশোরী মায়েদের। এইরকমই একজন রাজশাহী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীটি জানান, আমার ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। এখন আমার পাঁচ বছরের সন্তান আছে। বাল্যবিবাহের কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছি না। নানা রোগে ভুগছি। নিজের খরচ আর সন্তানের খরচ সামলাতে ও হিমশিম খাচ্ছি।

স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রেমের সম্পর্ক, বিদেশে থাকা ছেলে, সাবলম্বী বর কিংবা দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী মেয়ে এসব বিষয়কে কেন্দ্র করেই বেশি বাল্যবিবাহ ঘটছে। সামাজিক ও আর্থিক প্রলোভন বাল্যবিবাহকে বাড়িয়ে তুলছে। এতে কিশোরীরা অনেক সময় নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগই পান না।

৭

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যদি বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করেন, তাঁকে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তি হতে পারে। পিতা-মাতা বা অভিভাবক এতে জড়িত থাকলে তাঁদেরও ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। কোনো কাজী বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করলে তাঁর লাইসেন্স বাতিল হবে, পাশাপাশি ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে। শাস্তির বিধান থাকলেও বাস্তবে এ আইনের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। শাস্তির ভয়ে কাজী বা পরিবারকে এখনো সচেতন করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

এ দিকে চিকিৎসকরা বলছেন বাল্যবিবাহে স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই মারাত্মক। রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. এস আই এম রেজাউল করিম বলেন, বাল্যবিবাহ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিশোরীদের গর্ভধারণ মা ও শিশুর জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। জরায়ুর সমস্যা, অঙ্গভঙ্গের দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা সব মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদে তাদের জীবন বিপন্ন হয়।

তিনি আরও বলেন,হাসপাতালে গর্ভধারিণীরা প্রায় সবাই নিজেদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে পরিচয় দেন। ফলে চিকিৎসা দিতে গিয়ে প্রকৃত বয়স জানা যায় না। অর্থাৎ বাল্যবিবাহ শুধু আইনি নয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছেও একটি গোপন অপরাধ। রাজশাহীতে কিশোরী মায়ের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। অসাধু কাজী, সামাজিক চাপ ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা মা হয়ে পড়ছেন। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে মায়ের স্বাস্থ্য, নবজাতকের ভবিষ্যৎ ও দেশের জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা। আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এক প্রজন্মের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহীর পরিচালক অ্যাডভোকেট দিল সিতারা চুনি বলেন, বাল্যবিবাহ একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। ছেলে পক্ষ, মেয়ে পক্ষ, কাজী এমনকি ঘটক সবার শাস্তির বিধান রয়েছে। এর ফলে মা দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ হয়ে পড়েন, আবার শিশুও অপুষ্ট ও বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিতে পারে।

ইএফ/