বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক উপাচার্যসহ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে। তবে মামলার আসামিদের মধ্যে দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও অন্য তিনজন এখনো বহাল রয়েছেন। রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বেরোবির উপাচার্য থাকালীন অধ্যাপক ড. মু. আব্দুল জলিল মিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগে ১২ বছর আগে মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চের পক্ষ থেকে উপাচার্যের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ করা হয় দুদক চেয়ারম্যানের কাছে। পরে দুদক বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।

দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় রংপুরের তৎকালীন উপপরিচালক আব্দুল করিম অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পান। এরপর তিনি বাদী হয়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর উপাচার্যসহ দুইজনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। মামলার আরেক আসামি ছিলেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার মো. শাহজাহান আলী মণ্ডল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক রংপুরের উপসহকারী পরিচালক মো. আকবর আলী প্রায় ৩ বছর তদন্তকালে এজাহারভুক্ত দুজন ছাড়া বেরোবির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক এটিজিএম গোলাম ফিরোজ, সহকারী রেজিস্ট্রার মো. মোর্শেদ উল আলম রনি এবং অর্থ ও হিসাব বিভাগের সহকারী পরিচালক খন্দকার আশরাফুল আলমের সঙ্গেও ওই দুর্নীতির সম্পৃক্ততা পান। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা মামলায় ওই তিনজনকে আসামি করে ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের যে সত্যতা পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে-গোলাম ফিরোজ রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে প্রথমে ৯ম গ্রেডের পিএস টু পিডি পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পান। পরে মাত্র ২৫ দিনের ব্যবধানে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ৫ম গ্রেডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে স্থায়ী নিয়োগ লাভ করেন।

একই অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মো. মোর্শেদ উল আলম রনি সহকারী রেজিস্ট্রার পদে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ ছাড়াই নিয়োগ পান। তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের দুই বছরের মধ্যে চাকরিতে যোগদান করেন। অথচ ৫ বছরের শর্ত পূরণ করার কথা ছিল। তা গোপন করে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসাবে তাকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

খন্দকার আশরাফুল আলম ২০১০ সালের এপ্রিলে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পান। পরে একই পদে স্থায়ী না হয়েই তিনি সহকারী পরিচালক (বাজেট) হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিয়মিত চাকরি স্থায়ী দেখিয়ে তাকে উচ্চতর স্কেলের সুবিধাও দেওয়া হয়েছে।

রংপুরের দুদকের স্পেশাল জজ আদালতে মামলার বিচার শুরু হলে ২০১৭ সালের ২০ জুলাই আসামি আব্দুল জলিল মিয়া ও শাহজাহান আলী মন্ডল আত্মসমর্পণ করেন এবং আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠান। অন্য ৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

দুদকের চার্জশিট আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভায় শাহজাহান আলী মন্ডল, গোলাম ফিরোজ, মোর্শেদ উল আলম রনি ও খন্দকার আশরাফুল আলমকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এরপর ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর স্পেশাল জজ, রংপুর মামলার অভিযোগ থেকে গোলাম ফিরোজ, মোর্শেদ উল আলম রনি ও খন্দকার আশরাফুল আলমকে অব্যাহতি দেন। তবে আদালত উল্লেখ করেন যে, এ তিনজনের নিয়োগ লাভের সময় আসামি আব্দুল জলিল মিয়ার ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে থাকলে বা তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারে।

আদালতের এ আদেশের পরে সিন্ডিকেট সভায় ওই ৩ কর্মকর্তাকে ফের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পরবর্তী সময়ে সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া দুদকের মামলায় একাধিকবার বরখাস্ত হলেও অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) গোলাম ফিরোজ, উপ-রেজিস্ট্রার মোর্শেদ উল আলম রনি ও উপ-পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) খন্দকার আশরাফুল আলমের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে।

দুদকের পক্ষ থেকে বিচারিক আদালতে অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করা হয়। এরপর হাইকোর্ট তা মঞ্জুর করে আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ রদ-রহিত করে চার্জ গঠনের নির্দেশ দেন। ওই মামলা এখন ফের হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

এদিকে রংপুর স্পেশাল জজ আদালতে মামলার ধার্য তারিখ ছিল এ বছর ২৭ আগস্ট। এতে ৩ আসামি মামলাটি হাইকোর্টে আপিল বিভাগে শুনানির কারণ দেখিয়ে সময় প্রার্থনা করে কালক্ষেপণ করছেন।

২০১৭ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ৫৪তম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। তবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া একই মামলায় শাহজাহান আলী মন্ডল সাময়িক বরখাস্ত থাকলেও গোলাম ফিরোজ, মোর্শেদ উল আলম রনি ও খন্দকার আশরাফুল আলম বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন।

এ ব্যাপারে বেরোবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এসব বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। যুগান্তরের অনুসন্ধানকালে বিষয়টি জানতে পেরে আমি খোঁজ নিয়েছি। প্রশাসনের কোনো দপ্তর বিষয়টি আমার নজরে আনেনি। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, উপাচার্যসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি এ বিষয়ে আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সবকিছু দেখে যেভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, আমি তাই করব। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকলে নেব। আমি দুর্নীতির সঙ্গে কখনো আপস করিনি। তাই যা হবে, সচ্ছতার সঙ্গেই হবে।