নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চানন্দী ইউনিয়নের ইসলামপুর দাখিল মাদরাসাটি নদীভাঙনের তীব্রতায় পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে। এখন প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হারিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা গাছের নিচে খোলা আকাশের নিচে পাঠ নিচ্ছে। মানবিক উদ্যোগে চালু রাখা হয়েছে পাঠদান, কিন্তু অস্থায়ী এই ব্যবস্থায় নেই ন্যূনতম শিক্ষা পরিবেশ।

সম্প্রতি সরেজমিনে ইসলামপুর বাজার সংলগ্ন মাওলানা আব্দুল আহাদের বাড়ির উঠানে দেখা যায়, একটি আমগাছের ছায়ায় ১০–১২টি বেঞ্চে বসে পাঠ নিচ্ছে প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। পাশে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে পাঠ বলছেন দুইজন শিক্ষক। শিশুদের কেউ রোদের মধ্যে, কেউ আধা ছায়ায় বসে উচ্চস্বরে পড়া অনুসরণ করছে। কারও কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, তবু থেমে নেই শেখার চেষ্টা।

স্থানীয়রা জানায়, ইসলামপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে ২০০১ সালে ১৫০ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামপুর দাখিল মাদরাসা। দুটি বড় টিনশেড ঘরে পাঠদান হতো। কিন্তু চলতি বছর ভাঙনের ভয়াবহতায় মুহূর্তেই পুরো প্রতিষ্ঠান নদীতে তলিয়ে যায়। এখন সেখানে শুধু কিছু ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। পাশেই রয়েছে একটি আধাপাকা মসজিদ, যেটিও এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে।

ইসলামপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল খালেক বলেন, “গত ১০ বছরে চানন্দী ইউনিয়নে অর্ধশতাধিক মসজিদ, মাদরাসা ও বিদ্যালয় মেঘনার ভাঙনে হারিয়ে গেছে। ইসলামপুর মাদরাসাও সেই তালিকায় যুক্ত হলো।”

যেখানে নেই ছাউনি, নেই সামগ্রী—তবু চলছে পাঠ

মাদরাসার সহকারী শিক্ষক এ টি এম আমিরুল ইসলাম বলেন, একসময় এখানে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী পড়ত। ভাঙনের পর অনেক পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। এখন অস্থায়ীভাবে শতাধিক শিক্ষার্থী গাছতলায় পাঠ নিচ্ছে। রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, আর বৃষ্টি এলেই ক্লাস বন্ধ করতে হয়।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনো বেতনভাতা পাই না। তবু মানবিক দায়িত্বে শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি।”

মাদরাসার প্রধান মাওলানা আব্দুল আহাদ জানান, “দুই মাস আগে ভাঙন এতটাই তীব্র হয় যে পাঠদান বন্ধ করে দিতে হয়। তখন ২৮৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। ঘরের টিন ও বেড়া খুলে নিতে হয় নদীতে বিলীন হওয়ার আগে। এরপর কিছু শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, কেউ কেউ অন্য পেশায় চলে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে বাড়ির উঠানে গাছের নিচে ক্লাস চালাচ্ছি। সাতজন শিক্ষকের মধ্যে কেবল দুজন রয়েছেন। প্রতিদিন ৭০–৮০ জন শিক্ষার্থী আসে। কষ্ট হলেও থেমে থাকছি না। নতুন জমি পেলে ঘরগুলো আবার দাঁড় করিয়ে মাদরাসা চালু করার ইচ্ছা রয়েছে।”

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী বলেন, “ইসলামপুর মাদরাসা এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই মেঘনার ভাঙনের কবলে। সেখানে এখন মাদরাসা, বসতঘর বা সড়ক কিছুই অবশিষ্ট নেই। ইতোমধ্যে ভাঙনরোধে কয়েকটি এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। তবে ইসলামপুর নদীর গতিপথের মুখে হওয়ায় এখানে স্থায়ী সমাধান সময়সাপেক্ষ।”

ভাঙনপ্রবণ এলাকায় একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হলেও সেখানে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

তাদের একটাই আকুতি—নদী ভবন কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু শিক্ষা যেন থেমে না যায়।